সেরা কষ্টের গল্প শরতের নদীপথ | অবহেলার কষ্টের গল্প


বাস্তব জীবনের কষ্টের গল্প

সুরুজ আলী দুপুরের খাবার শেষ করে নদীর ঘাটে গেল। বেড়িবাধের সামনে ছেলেগুলো দাড়িয়ে আছে অনেকক্ষণ। ঈদের একদিন পরে পাড়ার ছেলেদেরে সাথে আমিও গেলাম নৌকা নিয়ে নদীতে ঘুরতে। 

নৌকায় বসে অবিরাম তাকিয়ে আছি যৌবন ভরা নদীর মাঝে জেগে ওঠা চরের দিকে। শত স্মৃতি এসে দোল দিচ্ছে মনের বারান্দায়। ফিরে গেলাম বিশ বছর আগের দিনগুলোতে।

কত দিন কত সন্ধ্যা, রাত যে কেটেছে এই নদীর চরে। রাত জেগে আখের রসের কড়াইয়ে জ্বাল দিয়ে গুড় বানানো। ভরা নদীতে সাঁতার কাটা। সকাল বেলা গরুর জন্য ঘাস কাটা। বিকেলে বন্ধুদের সাথে ফুটবল খেলা।


মেশিনের শব্দের তালে যমুনা নদীর উপর তরতর করে এগিয়ে চলছে আমাদের নৌকা। যমুনার নির্মল বাতাসে আমাদের মনের গহিনে বইছে ভালো লাগার পরশ।

আনমনে তাকিয়ে আছি যমুনার তীরের দিকে। যেগুলো কুয়াশায় ঢেকে যাওয়া ছবির মতো দেখা যায়। জেগে ওঠা চরের বুকে দাদাজানের শুভ্র চুল হয়ে কাশফুলগুলো হালকা বাতাসে দোলছে প্রিয়সির আলিঙ্গনের মতো।

সুরুজ এসে পাশে বসতেই ভাবনার ছন্দপতন ঘটে। ওকে বললাম, নৌকার হাল কাকে ধরতে দিয়েছো।

সুরুজ মুচকি হাসি দিয়ে বলল,

কোনো চিন্তা করেন না ভাইজান। কামালকে ধরতে দিয়েছি। আমার মতো এখনো দক্ষ হয়ে ওঠেনি। দক্ষ মাঝি না হলে এই যমুনার বুকে নৌকা চালান যায় না। সব জানতে হয় ভাইজান। তাই ওকে হাল ধরতে দিয়েছি, দক্ষ হোক।

সব বলতে কী কী জানতে হয় সুরুজ?

নদীর বাঁক চিনতে হয়। পানি চিনতে হয়। ঢেউ চিনতে হয়। স্রোত চিনতে হয়। রাতের জোছনার সাথে তারাগুলোকে চিনতে হয়। আর চিনতে হয় নদী পারের গ্রাম ও গ্রামের মানুষগুলোকে।

তাহলে তো অনেক কিছুই জানতে হয়রে সুরুজ।


আর একটি জিনিস থাকতে হয় ভাইজান। সেইটা হলো বুকের সাহস। এই সাহস না থাকলে রাতের বেলায় নৌকা চালনো যায় না। সুরুজের পান চিবানো শেষ হলে মনের সুখে একটা গান ধরে।

আহ্। কী সেই গানের মিষ্টি সুরের কলতান। উচ্ছ্বাসিত তরুণ-যুবকের দল খুশির ঢেউয়ে দুলছে। কতোই না আনন্দ পাচ্ছে তারা। কতো স্বপ্ন ভাসে তাদের চোখে।

নৌকার গতি আরো বেড়ে গেল। সাঁই সাঁই করে চলেছে সামনের দিকে। হাতের ডান পাশে একটি গ্রাম চোখে পড়ল। গ্রামটির এক পাশে আখের ক্ষেত। সামনের দিকে পাট কাঠি আঁটি বেঁধে শুকাতে দেওয়ার দৃশ্য।

গ্রামটির দক্ষিণ পাশে মোবাইলের একটি টাওয়ার দেখা যায়। নদীর পথ ভুলে যাওয়া মাঝিদের আশার আলো ওই টাওয়ার। অনেক দূর থেকে দেখা যায় গ্রামের বুকে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে টাওয়ারটি।

গ্রামের দিকে তাকিয়ে থেকে সুরুজকে বললাম, গ্রামটির নাম কি, সুরুজ?

ভাইজান, ওখানেই আমার জন্ম হয়। আমার দাদার বাড়ি। অনেক ঘটনা আছে ওই গ্রামে । শুনলে আপনার ভালো লাগবে।

আবার গ্রামের নাম জিজ্ঞেস করতেই সুরুজ হেসে উঠে বলে, এই গাঁয়ের নাম মানিকচর। বাপ-দাদার বাড়ি-ঘর ভেঙ্গে যমুনার পেটে গেল সেবার। তারপর আমরা চালুয়াবাড়ি চরে বসতি স্থাপন করি। সেই থেকে চালুয়াবাড়ি গ্রামে ছোট থেকে বড় হওয়া। এখানে মাঝে মাঝে যমুনার ঢেউ এসে হানা দেয় এখনো।


পিছন থেকে কামালের উচ্চ গলা শোনা যায়,

সুরুজ ভাই, তেল শেষ হয়ে গেছে। আর অল্প আছে। তেল নিতে হবে।

সুরুজ উঠে মেশিনের কাছে যায়। মেশিনের তেলের ট্যাংকির মুখ খুলে একটা কাঠি ঢোকায়। তারপর দক্ষ চোখে কাঠির তেল ভেজা দাগ দেখে। সুরুজ আবার আমার কাছে আসে। একটু উৎসাহ নিয়ে বসে। হয়তো গল্প করবে সে। সে এই পরিস্থিতিতে মজা পাচ্ছে।

ভাইজান, সামনে যে গ্রামটা দেখছেন সেখানে নৌকা ভিড়াবো। তেল নিতে হবে। উজানে যাইতেছি তাই তেল একটু বেশি লাগতেছে।

যেখানে আমরা বিরতি নিবো সেই জায়গার নাম কি।

উলিয়া ঘাট। এই ঘাটে একটি ছোট বাজার আছে।

মুচকি হাসি দিয়ে সুরুজ আলী বলে,

ভাইজান, এই গ্রামটি আমার অনেক পরিচিত ছিল। অনেক ঘটনা আছে এই গ্রামকে ঘিরে।


পরিচিত ছিল মানে?

পরে বলবো ভাইজান। আমার এক কষ্টের ভালোবাসার গল্প আছে।একটু সময় লাগবে বলতে। তাই সময় দেখে একসময় বলব।

উলিয়া ঘাটে নৌকা নোঙর করা হলো। ছেলেরা সব সেলফি তোলা নিয়ে ব্যস্ত। মাইকে কোনো এক রাজনৈতিক নেতার বক্তব্যের আওয়াজ শোনা যায়।

শরতের বিকেলে আকাশে ভাসমান থোকা থোকা সাদা মেঘের মতো আমরা তিনটি দল পাশাপাশি হেঁটে বাজারের দিকে যাচ্ছি। বাজারের সামনেই একটি উচ্চ বিদ্যালয়। সেখানে রাজনৈতিক দলের মিটিং চলছে। ঘণ্টাখানেক চা-নাশতার বিরতি শেষে নৌকা আবার রওনা করল

একটি বিয়ের নৌকা আমাদের অতিক্রম করতেই দুই নৌকার ছেলে- মেয়েরা আনন্দে করতালি দিয়ে উঠল। আহা! কত সুন্দর মনোরম দৃশ্য। মাইক বাজিয়ে নৌকা চলছে নতুন অতিথিকে ঘরে তোলার খুশির জোয়ারের তালে তালে। আর বর লজ্জায় আরোষ্ঠ হয়ে মুখে রুমাল চেপে মাথা নিচু করে বসে আছে।


পানি কেটে ঢেউর তালে নৌকা ছুটে চলেছে তরতর করে। উলিয়া ঘাটের ঠিক উল্টোদিক। অর্থাৎ পশ্চিম দিকে সুন্দর কাশবনের চর জেগে উঠেছে। ভাদ্রের বিকেলে সাদা বকের ঝাঁকের মতো হয়ে উঠছে কাশফুলগুলো। পুবালি বাতাস দোল খেলে যায় কাশফুলের আগায় আগায়। যতো ভিতরে যাওয়া যায় তত বড় আর ঘন কাশবন। 

মাঝ দিয়ে কয়েকটি হাঁটা পথের সরু রাস্তা সাপের লেজের মতো আরো ভেতরে দিক-বিদিক চলে গেছে। নদীর পানি শুকিয়ে গেলে, খাটিয়ামারি গ্রামের গোয়াল পাড়ার রাখালরা এখানে মহিষ চরায়।

অল্প কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা নদীর ওপারে পৌঁছে গেলাম। নদীর তীরে এমন বাজার আর দেখিনি। অনেক বড় বাজার। প্রাথমিকে পড়ে আসা সমাজ বইয়ের ছবির মতো বাজার।



পরবর্তী পার্ট পড়ুনঃ শিক্ষনীয় কষ্টের গল্প শরতের নদীপথ পার্ট ২

Check Also

ছোটদের গল্প রূপকথার গল্প | সাহসী বালক পার্ট ৩

প্রথম পার্ট: ছোটদের রূপকথার গল্প সাহসী বালক দ্বিতীয় পার্ট: ছোটদের কাল্পনিক গল্প সাহসী বালক পার্ট ২ তার …

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *