সেবার টিউশনির টাকা বাকি পড়ে গেল। টানা দুইমাস গাধার খাটুনি শেষে ছাত্র ভালো স্কুলে ভর্তির সুযোগ পেল। ভাবলাম, এবার বেতন যলদি যলদি পেয়ে যাবো। কিন্তু ছুটির আগের দিন ছাত্রের মা হাসপাতালে ঠাঁই নিলেন।
পরেরদিনই বাড়িওয়ালা খালাম্মা ভাড়া চাইতে এলেন। আমি আমার জীবনের গল্প বললাম তাকে। বললাম, আমার কাছে বাড়ি যাবার ভাড়া নেই। বাড়ি থেকে টাকা পাঠানোরও কোন অপশন নেই।
খালাম্মা পাচশত টাকার একটা কড়কড়ে নোট আমাকে দিয়ে বললেন, আসার সময় আমার জন্য কিছু ফল নিয়ে এসো। মুচকি হেসে আমিও বলেছি, একটা কেন এই টাকায় অনেক ফল অনায়াসে ব্যাগে ভরে নিয়ে আসা যায়।
বাড়ি থেকে আসার সময় লালমাই পাহাড়। লালমাই হতে এক কিলোমিটার পশ্চিমে চাঁদপুরের দিকে এগুতেই মেঘের সঙ্গে হেলান দিয়ে ঝুলে আছে লালচে টেম্পল। সিঁড়ি দিয়ে চলে গেছে মেঘের বাড়ি।
সুনসান নীরবতা লোকজনের তেমন আনাগোনা নেই। মাটি থেকে তলায় তলায় অসংখ্য গাছেরা যেন উপরে উঠার প্রতিযোগিতায় নেমেছে। চূড়ায় তাদের উঠতেই হবে।
এদের মধ্যে যারা বেশি আকাশ ছোঁয়ার দাবীদার তারা শিরিষ । কি নির্বিকার আকাশের দিকে ছুটে চলে গেছে এখানে না এলে দেখার উপায় কোথায়!
বসন্তের শেষদিকে শিরিষ গাছেতলায় বীজ পড়ে জমা হয় চারপাশে। লাল চুলের বুড়ি পাগলীটা আমাকে বলেছিলো।
হাতে আটদশটা বীজ নিয়ে একটা পাতায় মুড়ে আমার হাতে দিয়ে বললো,
শিলাবৃষ্টির পানিতে ভিজিয়ে নরম মাটিতে বুনে দিন। একদিন অনেক গাছ হবে।
বীজ থেকে গাছ হবে শুনে বীজগুলো পকেটে পুরে নিলাম। ঢাকায় এসেই খালাম্মার সামনে পড়লাম। কচুর লতি, কাঁঠালের বিচি আর নোনা ইলিশ পেয়ে ভাড়ার কথা বেমালুম ভুলেই গেছিলাম।
রাত সাড়ে এগারোটায় দরজার কড়া নড়লো। খুলে দেখি খালাম্মা। গম্ভীর গলায় বললেন, আমার ভাড়ার জন্য বাড়িতে গেলে, ভাড়া কই?
খালাম্মা বাড়ি থেকে নগদ টাকা আনতে পারিনি। তবে কিছু বীজ এনেছি, এগুলো বিক্রি করে আপনার বকেয়া পুরো ভাড়া দিয়ে দেবো।
কিসের বীজ?
খালাম্মা, শিরিষের বীজ, এটা শুধু বোটানিক্যাল নার্সারিতে বিক্রি হয় । আপনি বুঝবেন না ওসব।
তিনি বীজ দেখতে চাইলেন। পাকা জলপাই পাতায় মোড়ানো বীজগুলো তাঁর হাতে তুলে দিলাম। অনেকক্ষণ নেড়েচেড়ে বললো, এগুলোর দাম কতো।
পঞ্চাশ পার্সেন্ট ডিসকাউন্ট দিয়ে বললাম, পঞ্চাশ হাজার টাকা। খালাম্মা বললেন, তোমার মনে হয় কোথাও খটকা আছে এই কইয়েকটা বীজের দাম পাঁচ টাকার বেশি হবার কথা নয়।
খালাম্মা আগেই বলেছি এই বীজ আপনার জন্য নয়। আমি এটা কোন এক বোটানিক্যাল নার্সারিতে বিক্রি করবো। একমাত্র ওরাই এর কদর জানে। আপনি শিমবিচির সাথে এর তুলনা করছেন। লাউ কুমড়োর বিচি হলে না হয় মিলতো। আরে এ তো যে সে বীজ নয়, শিরিষ গাছের বীজ। মাটি থেকে হেঁটে হেঁটে মেঘ অবধি উড়ে
যায় এ গাছ।
খালাম্মা পাতায় মোড়ানো বীজগুলো আবার যতন করে দেখলেন। বললেন, আমি মিমির সাথে কথা বলে নিই আগে। এরপর তোমাকে ফেরত দিলে বিক্রি করো। বলেই হনহন করে নেমে গেলেন।
মিমি ওনার বড়ছেলের বউ, সরকারী কলেজে জীববিজ্ঞান পড়ান। তাঁদের একটা বিশাল খামার বাড়ি আছে কাপাসিয়ায়। ওখানে বিরল ও বিশাল প্রজাতির গাছের সমারোহ ঘটাচ্ছেন শাশুড়ীবউ মিলে। মনে মনে ভাবলাম, তিন-চার মাসের ভাড়ার একটা বন্দোবস্ত করে দিলো বুড়ী পাগলীটা।
পরের দিন সকালে খালাম্মার দরবারে ডাক পড়লো। মিমি ভাবী খুব মিষ্টিমুখ করে বললেন, শিরিষের বীজগুলো খুবই ভালো প্রজাতির। এর একটা চারার দাম তিরিশ হাজার টাকা। কিন্তু বীজ হিসেবে পঞ্চাশ হাজার টাকা বেশি হয়ে যায়। তুমি কিছু কমিয়ে নিলে আম্মু কিনতে চায়।
বললাম, যার বীজ তাকে দিতে হবে পয়ত্রিশ হাজার। আর আমার জন্য ছয় হাজার টাকা।
সাত-আট না হয়ে ছয় হাজার কেন জানতে পারি ?
খালাম্মা আমার কাছে তিন মাসের ভাড়া পায়। সেই হিসেবে বলছি। খালাম্মা পয়ত্রিশ হাজার টাকা তিনবার গুনে আমার হাতে দিয়ে বললো, এই নাও তোমার চলতি মাসের ভাড়াও আর দিতে হবে না।
বললাম, শিলাবৃষ্টির পানিতে ভিজিয়ে নরম মাটিতে বুনে দিবেন গাছ আকাশের দিকে ছুটে যাবে। যদিও কিছু লস হলো তবু আপনাকে দিয়ে আনন্দ লাগছে বীজগুলো সমঝদারের কাছে আশ্রয় পেয়েছে। সকাল সকাল ভালোই আয় হয়েছে।
পরবর্তী পার্ট পড়ুন: শিরিষ গাছ পার্ট ২