প্রথম পার্ট পড়ুন: অতীতের স্মৃতি নিয়ে গল্প শিরিষ গাছ
তেঁতুলিয়ার শ্যাওলাপড়া পুরান গাছগুলোর কথা মনে পড়লো খুব। ডাকবাংলোর ফায়ারপ্লেস আর মহানন্দার চিরলআইড় পুড়ে খাবার লোভে রাতেই বাসে চড়ে বসলাম। চাকরির সংবাদ পেলাম। যদিও চুক্তিতে নিয়োগ তবুও খুশি হলাম।
ঢাকায় ফিরে খালাম্মাকে মিষ্টিমুখ করালাম। বললাম, প্রথম পোস্টিং শিরিষের দেশ বান্দরবান। বাসাটা ছারতে মন চাইছে না।
তিনি বললেন, তুমি কোন একজন স্টুডেন্ট এর সাথে শেয়ার করো। ভাড়া অর্ধেক হয়ে যাবে। আর ঢাকায় এলে উঠার একটা জায়গাও থাকবে। হাঁ সূচক মাথা নাড়িয়ে চাবিটা তাঁর হাতে তুলে বললাম।
আজ রাতের গাড়িতে চড়ছি, কাল জয়েন। দোয়া করবেন।
সেই তো বান্দরবান, এরপর টেকনাফ, কুয়াকাটা, গোয়া, পুরি, কলম্বো, মালে হয়ে যেই কাবুল উপত্যকায় নামবো তখনই মেয়াদ শেষ।
টানা ছয় বছর পর বিরতি। একদিন নিজের ঢাকার বাস্তব জীবনের গল্প মনে পড়ল। ফিরলাম ঢাকায়। আমার রুমে অচেনা রুমমেট। বললো, শিরিষ ভাই এখানে থাকেন। আমি শুধু এটুকুই জানি।
নিচে নেমে মিমি ভাবিকে জিজ্ঞেস করলাম, খালাম্মাকে দেখছি না উনি কোথায়? বললেন মা এখন শিরিষের দেশে। কবরের চারপাশে কেবল শিরিষের গাছ। একদিন গিয়ে দেখা করে এসো। রাজেন্দ্রপুর থেকে তেরো কিলো উত্তর পূর্ব দিকে গগনশিরিষ ।
যাই যাচ্ছি করতে করতে চলে গেলো আরো তেরো বছর। মিমি ভাবীর ছেলে পিয়াল ফোন করলো একদিন। জানালো, পরের শুক্রবার শিরিষ বাগানে ওর দাদীর জন্য মিলাদ। আমি যেন উপস্থিত থাকি। ওর মা ও বাবা দুজনেই বারবার ওকে তাগাদা দিচ্ছে। বললাম, যে করেই হোক আসবো। পিয়াল জানালো ওরা সকালে গাড়ি নিয়ে রওনা হবে আমিও যেন ওদের সঙ্গে যাই।
শুক্রবার সকালে অবিরাম বৃষ্টি। সকালে ঘুম গভীর হয়ে আসছে। ওদিকে পিয়ালের একটানা কল হচ্ছে তো হচ্ছেই। রিসিভ করে বললাম, বৃষ্টি একটু কমুক, নাহলে একেবারে ভিজে যাবো। পিয়াল বললো, ছাতা নিয়ে চলে আসুন। আম্মু আব্বু দুজনেই অপেক্ষা করছে। ছাতার কথা মনেই ছিল না।
ছাতা নিয়েও প্রায় ভিজে ওদের বাসায় চলে আসি। আমি আসতেই গাড়ি গেটে চলে আসলো। সিটে বসতেই চলতে শুরু করলো। মোটামুটি দুই ঘন্টায় গাড়ি শিরিষে বাগানে পৌঁছে গেল।
এমন ছায়া সুনিবিড় রিসোর্ট খুব কমই আছে। এক পাশে বেশ কয়েকটি গাছ যেন গভীর মিতালি করছে। এগিয়ে দেখলাম, মার্বেল পাথরে বাঁধানো একটা সমাধি। মাথা ও পায়ের দিকে দুটি করে আর ডানে ও বামে তিনটি করে মোট দশটি বিশাল শিরিষ গাছ।যেন আকাশের সাথে মিশে গেছে।
মিমি ভাবী বললেন, এগুলোই তোমার কাছ থেকে কেনা বীজ । এখন দেখো এক একটার দাম কতো। মা অনেক যত্ন করে এগুলোকে এখানে বুনে রেখেছেন।
পিয়ালের বাবা মেজর সাহেব বললেন, আপনার জন্য একটা সুসংবাদ আছে। মা আমাদের ওসিয়ত করে গেছেন, গাছগুলোর পনের বছর হলে আপনার ডিসকাউন্ট দেয়া সাতান্ন হাজার টাকা ফেরত দিতে।
আমি কিছুটা বিস্মিত হলাম। এক বীজ কয়বার বিক্রি করা যায়। তাঁকে বললাম, খালাম্মা আমাকে এমনিতেই অনেক স্নেহ করতেন।
কিন্তু বীজগুলোর বিষয়ে আমার কিছু কথা আছে।
তাদের সবকিছু খুলে বললাম। লালচুলো বুড়ি পাগলি, মেঘবাড়ি টেম্পল আর লালমাই পাহাড়ের কথা।
মেজর সাহেব হাসলেন, বললেন, মা বৃক্ষপাগল ছিলেন। আপনার কাছ থেকে বীজ কিনে হয়ে গেলেন শিরিষ গাছপ্রেমী। সাতান্ন হাজার টাকা আপনাকে নিতেই হবে। মায়ের অসিয়ত আমি অমান্য করতে পারি না।
মেজর সাহেব একটা সবুজ খাম বের করে আমার হাতে ধরিয়ে দিলেন। বললেন, প্রয়োজনে ওই টেম্পলের পাগলদের জন্য টাকাটা খরচ করবেন।
বললাম, পাগলদের টাকা লাগে না। আপনি বরং এ টাকায় এখানে আরও কিছু গাছ লাগান।
মেজর সাহেব অনেকটা জোর করে খামটা আমার পকেটে ঢুকিয়ে দিলেন। বললেন, এটা নিয়ে আর কোন শব্দ করা যাবে না।
শিরিষতলার চারপাশে দুটো চক্কর দিয়ে আকাশে তাকালাম। ডাল থেকে ঝিরিঝিরি পাতা পড়ছে। এ যেন আমাকে স্বাগত জানাচ্ছে প্রিয় বন্ধুরা। পাখিরা কিচির মিচির করছে। কি মিষ্টি সে ডাক। নিজের অতীতের গল্প মনে করে নস্টালজিক হয়ে গেলাম।