আষাঢ়ের রাত। বাইরে মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। রাত ১০ টা বা ১১ টা হবে। এই প্রত্যন্ত গ্রামের প্রায় সবাই গভীর ঘুমে।
কিন্তু হাসিবের মা রহিমার চোখে ঘুম নেই। তিনি অপেক্ষা করছেন কখন তার ছেলে বাড়ি ফিরবে। কখন তার সোনা-মানিক বাড়ি ফিরবে।
সে তার আসার পথ চেয়ে বসে রইছে। হাসিব বাজার থেকে চাল আর ডাল আনলে, তারপর সে চুলোয় ভাত চড়াবে।
তাদের এই গ্রামটা বাংলাদেশের একটা প্রত্যন্ত গ্রাম । এই গ্রামের প্রায় সবাই গরীব। তারা দিন আনে দিন খায় । সারাদিন পরিশ্রম করে যা রোজগার করে তা দিয়েই তারা সে দিনটা চালায়। যেদিন কোনো কাজ থাকে না, সেদিন তারা না খেয়ে থাকে।
একই অবস্থা হাসিবের পরিবারের। হাসিবের জন্মের পর তার বাবা মারা যায়। তারপর তার চাচারা তাদের সব জমি দখল করে নিয়ে যায়। তার বাবার বাজারে দোকান ছিল । তা দিয়ে তাদের ভালো ভাবেই সংসার চলত।
কিন্তু তার বাবার মৃত্যুর পর সব পাল্টে যায়। তার বাবার দোকানটাও চাচারা নিয়ে যায়। এরপর তাদের দুঃসময় শুরু হয়।
তার মা অন্যের বাড়িতে বুয়ার কাজ করা শুরু করে। হাসিব ক্লাস ফাইভ পর্যন্ত পড়ালেখা করেছিল। কিন্তু তারপর সে সংসারের দায়িত্ব নিজ কাধে তুলে নেয়।
তার মা অনেক কষ্টে হাসিবের চাচাদের কাছ থেকে দোকানটা নেয়। হাসিব তখন থেকেই সে দোকানটা চালায়। সে সকাল খুব ভোরে দোকানে যায় আবার দুপুরে আসে । বিকালে আবার দোকানে যায় ও রাত ৮ টা ৯ টার মধ্যে বাসায় ফিরে আসে।
কিন্তু আজ রাত ১১ টা বাজে। এখনও সে বাসায় ফিরে আসছে না। রহিমা পথ চেয়ে বসে থেকে এসবই ভাবছিলেন।
হাসিব প্রত্যেক শুক্রবার ও শনিবার বিকেলে মাঠে ফুটবল প্রাকটিস করে। স্থানীয় এক হাই স্কুলের শিক্ষক তাদের ফুটবল প্রাকটিস করান।
তিনি বাল্যকালে ফুটবল খেলোয়ার হতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তিনিও দারিদ্যতার কারণে তার সপ্ন পুরণ করতে পারেননি। তাই তিনি কিছু ছেলেদের ফুটবল প্রাকটিস করান। কারণ তিন চান না যে তার মত তাদের সপ্নও অপূর্ণ থাকুক।
এখানে যারা কোন প্রাকটিস করে তাদের সবারই বাবা আছে। কিন্তু হাসিবেরই বাবা নেই। সবার গায়ে ভালো জামা থাকলেও, হাসিবের গায়ে ছেঁড়া জামা।
এসব ভেবে আফসোস করতে থাকলেন রহিমা। তার তো সেই সামর্থ্যও নেই যে তাকে ভালো কিছু কিনে দিবেন। তিনি হাসিবের আসার অপেক্ষা করতে লাগলেন।
ফজরের পবিত্র আজানের সুরে তার ঘুম ভাঙল। সারা রাত্র তিনি অপেক্ষা করেছিলেন। কিন্তু কখন যে ঘুমিয়ে গেলেন। তিনি হাসিবের খোজ করলেন। হাসিব এখনও বাড়ি ফিরেনি।
হাসিব গতকাল বিকেল বেলা বাসা থেকে বের হয়েছিল। রাত্র গড়িয়ে সকাল হলো। কিন্তু এখনও সে বাড়ি ফিরলোনা। মায়ের মনে অজানা আশংকা ঘুরপাক খাচ্ছে।
তাদের বাড়িটা জঙ্গলের ভিতরে । আশেপাশে কোনো এই বাড়ি ঘরও নেই, যে তাদের হাসিবের কথা বলবে।
রহিমা ফজরের নামাজ পরলেন। মুনাজাতে হাসিবের জন্য অন্তর থেকে দোয়া করলেন।
বৃষ্টি এখন প্রায় থেমে গেছে। রহিমা, হাসিবের দোকানের উদ্দেশ্যে রওনা হলেন। কিছুদূর যেতেই কাউকে এদিকে আসতে দেখলেন।
এযে হাসিব!
হাসিব কে দেখে তার মা তাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে কেঁদে বললেন- সারারাত কোথায় ছিলি। আমি সারারাত্র তোর অপেক্ষায় ছিলাম।
বৃষ্টি পরছিল দেইখা, আমি দোকানেই থাইকা গেছিলাম। অন্য দোকানিরা ছাতা দিয়ে বাসায় চইলা গেছিল। কিন্তু আমার তো ছাতাও নাই। সকালে বৃষ্টি কম ছিল। তখন বন্ধুরা মিলে বাজারের পাশের পুকুরটাতে জাল মারছিলাম। একটানা বলে গেল হাসিব। বলেই সে মাছের পুটলিটা তার মাকে দেখাল।
মা বললেন- বাবা, কিছু খেয়েছিস?
না, মা। কিছু খাইনাই। পেটে অনেক ক্ষুদা লাগছে। এই মাছগুলি ভেজে ভাত দেও। হাসিব বলল।