কুকুর হচ্ছে মানুষের প্রথম পোষা প্রাণী। আদিকালে গুহাবাসী মানুষ কুকুর পুষত। তখন তারা এ প্রাণীটিকে খুব বিশ্বাসী প্রাণী মনে করত। তাই তারা বিভিন্ন শিকার করার সময় কুকুর সঙ্গে রাখত এবং তাদের সাহায্যে কুকুরটিকে ব্যবহার করত।
আমার নানা রাতের বেলা বাড়ি পাহারা দেওয়ার জন্য কুকুর পুষেছিলেন। তাঁর কুকুরটা ছিল বেশ সাহসী এবং শক্তিশালী।
গৃহপালিত হাঁস, মুরগি, গরু, ছাগল, কবুতর সব হেফাজতে রাখার দায়িত্ব ঐ কুকুরটার ওপর। দিনে কিংবা রাতে টের পেলেই কুকুরটি শত্রুকে তাড়া করত।
মুরগি ধরতে আসা বহু শিয়ালকে সে ঘাড় মটকে দিয়েছে। চোরের পা কামড়ে দিয়েছে। দাদাভাই বাড়িতে ঢোকার রাস্তায় ‘কুকুর হাতে সাবধান’ কথা লিখে রেখেছিলেন।
কুকুরটি সেখানেই থাকত। পরিচিত লোকজনদের সে কিছুই করত না। আর অপরিচিত লোক দেখলেই ঘেউ ঘেউ শুরু করত। পরিচিত কেউ তাকে থামতে না বলা পর্যন্ত সে থামত না।
তখন শীতের রাতে প্রচুর কুয়াশা পরত। কুয়াশার জন্য বেলা বেড়ে গেলেও সূর্য দেখা যেত না। আর নতুন ধান ঘরে এলে কৃষকরাও শান্তিতে অনেক বেলা পর্যন্ত ঘুমাত। তাদের সেই ঘুম-আরামের ফাঁকে চোরেরা চুরি করার জন্য সুবিধাজনক বাড়িতে হানা দিত।
কিন্তু আমাদের দাদাবাড়িতে কুকুর থাকায় তারা মাঝে মাঝেই তাড়া খেয়ে পালিয়ে যেত। কেউ দৌড়ে গাছে উঠে আত্মরক্ষা করত। কেউ কুকুরকে শক্ত লাঠি, রড প্রভৃতি দিয়ে আঘাত করে চলে যেত। চুরি করতে পারত না।
এমনই এক শীতের রাতে একদল চোর ঘরে ঢুকলে কুকুরটি ঘেউ ঘেউ শুরু করল। কুকুরটি চোরদের হাতে শাবল গাঁইতি দেখে ভয় পাচ্ছিল, আবার তেড়ে আসছিল।
দাদাভাই তখন প্রচণ্ড অসুস্থ ছিলেন। বাড়িতে তিনি ছাড়া বিশেষ কেউ ছিল না। তিনি টের পেয়েও বুড়ো মানুষ হওয়ায় উঠতে পারেননি। কয়েকজন চোর যখন গোলা ঘর থেকে বস্তা ভরে ধান নিয়ে যাচ্ছিল, তখন দাদাভাই চুপচাপ দেখছিলেন।
তাদের দুজনের মাথায় দুই বস্তা ধান, একজনের এক হাতে একটা বড় শাবল, অন্য হাতে টর্চলাইট। চোরটি টর্চের আলো ফেলে বস্তা মাথায় চোর দুজনকে পথ দেখিয়ে নিয়ে যাচ্ছে।
কুকুরটি সহ্য করতে না পেরে একজন চোরের পা কামড়ে ধরল। সঙ্গে সঙ্গে ঐ চোরটি শাবল দিয়ে কুকুরের মাথায় জোরে এক ঘা বসিয়ে দিল। কুকুরটি আর্তনাদ করে উঠল।
দাদাভাই তখন আর বিছানায় থাকতে পারলেন না। তাকে উঠতে দেখে ধানের বস্তা ফেলে চোরগুলো পালিয়ে গেল। কুকুরটা তখনও মাটিতে পড়ে একটানা আর্তনাদ করে যাচ্ছিল।
মাথা থেকে রক্তধারা বয়ে গেল। পরদিন বিভিন্ন গাছগাছড়া বেঁটে, হলুদ-মরিচ বেঁটে সেখানে পট্টি বাঁধা হলো। কিন্তু তাতে খুব একটা ফল হলো না।
কুকুরটা খাওয়া বন্ধ করে দিয়ে একটানা আর্তনাদ করতে থাকল। দিন-রাত কুকুরটির এমন আর্তনাদে বাড়ির সবাই কষ্ট পেল। সবচেয়ে বেশি কষ্ট পেলেন দাদাভাই।
এক রাতে দুজন লোক ডেকে তাদের টাকা দিয়ে বললেন কুকুরটাকে বস্তায় করে নদীর ওপাড়ে রেখে আসতে। তারা তাই করল। নদীর পাড়ের শিয়ালগুলো টানাটানি করে তাকে কোথায় কোন গর্তে নিয়ে গেছে পরদিন আর কেউ খুঁজে পায়নি।
কথাগুলো বলতে বলতে দাদার চোখ থেকে ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু গড়িয়ে পড়ল। আজ দাদা নেই কিন্তু তাঁর বলা সেসব কথা আজও মনে পড়ে। পোষা প্রাণীর প্রতি তাঁর মমতার কথা ভাবলে আমারও দুচোখ ভিজে ওঠে।