প্রথম পার্ট পড়ুন: অবহেলার কষ্টের গল্প শরতের নদীপথ
নৌকা নিয়ে কেনাকাটা করতে আসতেছে দূরের গ্রামের লোকজন। বৈঠার নৌকার চেয়ে ইঞ্জিনের নৌকা বেশি। শেষ বিকালে নৌকাগুলো হেলেদুলে চলছে তাদের গন্তব্যে।
বাজারের পশ্চিম পাশে বড় করে প্যান্ডেল সাজানো আছে। রঙ-বেরঙের আলো জ্বলছে বিকাল থেকেই।
দোকানে বসে চায়ের কাপে চুমুক দিতেই সুরুজ আলী কাছে এসে বসে। মাইক থেকে ভেসে আসছে সার্কাসের গান।
সুরুজ বলে, ভাইজান, এখন তো আর সেই সার্কাস হয় না। সার্কাস দেখবেন?
না। হাতে সময় কম। সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসছে। নদীপথ মানে বিপদের পথ। আর দেরি করা যাবে না। ওদেরকে ডেকে নিয়ে নৌকায় চলে এসো।
ভাইজান একটা কথা বলি?
বলো।
এই বাজার, উলিয়া ঘাট, ইসলামপুর জুড়ে আমার অনেক স্মৃতি আছে।
তাই! বলো। শুনি। –
হুম ভাইজান। এখন বলছি শোনেন। পৌষের দুপুরে নৌকা উলিয়া ঘাটে ভিরেছি। পাটের আঁটি নিয়ে এসেছি। এখান থেকে গাড়ি বোঝাই করে পাট নিয়ে যাবে ইসলামপুর সদরে। সেখান থেকে জামালপুর গুদামে।
মহাজন আসতে অনেক দেরি হবে। ও জানে আমি ঘাটে বসে আছি। হঠাৎ করে সেই দিন শেফালির সাথে বিয়ে হয়। শীতের রাত। শুক্ল পক্ষের জোছনার আলো মোমের মতো গলে পড়ছে উঠানজুড়ে। সেই রাত থেকে আমার ছায়া হয়ে থাকতো সব সময়।
থাকতো মানে। এখন সে কোথায়?
বলছি ভাইজান। এভাবে সুখের দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল ভালোই। শেফালির পরম ভালোবাসায় আমার হৃদয় ভরে উঠে খুশির জোয়ারে।
একদিন গেছি নদী পাড়ের হাটে। মহাজন বাজার থেকে পাট কিনে। আমার মহাজন নামকরা মানুষ। সবার কাছে তিনি হাসান নামে পরিচিত।
রাত করেই বাড়ি ফিরছি। উঠোন ভর্তি মানুষ। সবার চেহেরায় কান্না। তারপর সবই শুনলাম। শেফালির উপর অত্যাচার করা হয়েছে। এর বিচারের পরিবর্তে হলো প্রহসন।
শেফালির সারা শরীরে পাকা বাঁশের কঞ্চির দাগ। হাঁটতে পারছে না। মুখে কোনো কথা নাই শেফালির। নীরবে দুচোখ বেয়ে পানি ঝরছে। মাঝে মাঝে মুখ বাঁকা করে আৎকে উঠছে। পিঠে করে ঘরে নিয়ে এলাম। দুদিন পর একটু সুস্থ হয়ে উঠল।
শেফালি আর আগের মতো নেই। ঘর থেকে বের হয় না। ঠিকমতো খাবার খায় না। শরীরের যত্ন নেয় না। আমার কাছে বসে না। কাছে আসতেই লজ্জা আর ভয়ে ফ্যাকাসে হয়ে উঠে তার রাঙা মুখ। মন মরা হয়ে থাকে। কী যেন ভাবে।
হঠাৎ আমাকে বলে, আমাকে ভুল বুঝবে না বলো? আমার কোনো দোষ নাই। এ কথাগুলো বলেই দীর্ঘ নিঃশ্বাস শেফালির বুকের পাঁজর ভেঙে বের হয়ে আসে।
হয়তো চেয়ারম্যানের বড় ছেলেকে অপকর্ম থেকে বাঁচানোর কুট-কৌশলের প্রতি ঘৃণায় শেফালি রাগে মুখ কালো করে আছে। সেই কালো মুখ আমার চোখে ভাসবে চিরদিন।
তারপর আর কি হলো সুরুজ?
তারপর থেকে এই উলিয়া ঘাট আর হাটের সাথে সম্পর্ক শেষ হয়ে যায়।
উলিয়া ঘাট আর হাটে আসা বড় কথা নয়। মূলত নৌকা ভ্রমণই ছিল মুখ্য। তবুও দেখা হলো ইসলামপুরের গ্রামগুলো।
সূর্য পশ্চিম আকাশে উঁকি দিয়ে সন্ধ্যাকে হাতছানি দিয়ে ডাকছে। হলুদ রঙের আভায় ভরে গেছে পশ্চিমাকাশ। সুরুজ নৌকা ছেড়ে দিলো। মেশিনের ভট ভট শব্দে নৌকা এগিয়ে চলছে ঘাটের দিকে।
বাজার থেকে আমরা এখন সেই উলিয়া ঘাটের পশ্চিম পাশ দিয়ে যাচ্ছি। মেশিনের শব্দ ভেদ করে সেই কাশবন থেকে চিৎকারের আওয়াজ ভেসে আসছে। সবাই কিছুক্ষণ স্তব্ধ হয়ে রইলাম।
সুরুজ অতি আগ্রহ নিয়ে নৌকা ভিরালো কাশবনের কাছে। চিৎকার আরো স্পষ্ট হয়ে উঠছে। সেই চিৎকার বাতাসে প্রতিধ্বনি হয়ে কানে এসে বাজছে। লোকজনের আনাগোনার আওয়াজ পেয়ে আমাদের কাছে প্রায় চলে এলো।
তিনজনের সাথে একটি মেয়ে। মেয়েটি তখনো আকুতি করে বলছে-আমাকে এখন ছেড়ে দিন। আমি জানতাম না আপনারা এত নিচু মানুষ। আমি সার্কাস পেটের অভিনয় করি।
সুরুজ তখন হিংস্র হয়ে ওঠে। চিৎকার দিয়ে বলে, তুই তো চেয়ারম্যানের বড় ছেলে।
সুরুজের গলার রগগুলো রাগে আরো ফুলে উঠছে। পেশিগুলো লোহার মতো শক্ত হয়ে উঠলো। নৌকা থেকে নেমেই সে চেয়ারম্যানের ছেলের সাথে ঝগড়া বাধিয়ে দিল। ঝগড়া হাতাহাতির পর্যায়ে পৌঁছে গেল।
নদীর কিনারায় টলতে থাকা চেয়ারম্যানের ছেলেকে এক লাথি দিয়ে ফেলে দিলো যমুনার স্রোতে। সুরুজের দুই চোখ ভিজে উঠল। গাল বেয়ে ঝরে পরা সেই পানি সুখের না দুঃখের, প্রতিশোধের না কষ্টের, তা শুধু সুরুজ আলীই জানে।