আমরা ছোটরা একদিন রোকন দাদুর লম্বা বারান্দায় বসে গল্প করছি। বাইরে একটানা মুশলধারে বৃষ্টি হচ্ছে। তাই আমরা সকলে জড়ো বারান্দায় জড়ো হয়েছি গল্প শুনব বলে। রোকন দাদু ছিলেন আর্মির মেজর। চাকরি থেকে অবসর পেয়েছেন বেশ আগে। এলাকায় তবু তিনি মেজর নামেই পরিচিত।
রাস্তার ওপারে বাঁশবাগানের মাথায় এক জোড়া ঘুঘু হালকা হাওয়ায় দোল খাচ্ছিলো। হঠাৎ দাদুর চোখ সেদিকে যেতেই তিনি মৃদু হেসে বললেন, পাখি দুটো কী সুন্দর দোল খাচ্ছে । এখন তো ঘুঘু চোখেই পড়ে না। তিনি এক দৃষ্টিতে পাখিগুলো দেখছেন।
বৃষ্টি থামার কোনো লক্ষণ নেই। বাতাসে শীতের ছোঁয়া। আমরা যারা একটু বড় তারা সবাই বললাম, দাদু আপনি তো মেজর থাকতে সুন্দরবনে গিয়েছেন, সুন্দরবনের মজার কোনো গল্প বলুন না!
দাদু আমাদের প্রতিদিন নানান রকম গল্প শুনান। আমরাও তার অবসফ সময়ে গল্প বলার জন্য বায়না ধরি। তিনি আমাদের বায়না ফেলতে পারেন না।
দাদু আমাদের উৎসাহ দেখে মনে মনে কিছু ভাবতে লাগলেন। সবাই চুপচাপ। দাদু বাইরে বৃষ্টি পরা দেখছেন। তারপর হঠাৎ কিছু মনে করে তিনি হেসে উঠলেন। আমরা তখন ভীষণ আনন্দিত। ভাবছি সত্যিই মজার কোনো ঘটনা দাদুর মনে পড়েছে। তিনি হয়তো আমাদের কোনো নতুন হাসির গল্প বলবেন।
দাদু বললেন- অনেকদিন পর আবার সেই ঘটনাটা মনে পড়লো । একবার আমি একাই তিনটা চোরকে পাকড়াও করেছিলাম। সে কথা মনে হলে এখনো আমার হাসি পায়।
আমরা বললাম- দাদু আপনার সেই বাস্তব হাসির গল্প টাই আগে বলুন।
দাদু বললেন- সে আরো আগের কথা! তখন এই গ্রামে এখনকার মতো পাকা বাড়ী ছিল না। প্রায় সব ছিল মাটির ঘর। অল্প কিছু টিনের ঘর ছিল। যশোর সেনানিবাসে ট্রেনিংয়ের পর টেনিং চলছে আমাদের।
তখনো আমি মেজর হইনি। ছুটি নেই বললেই চলে। এদিকে বাড়ি থেকে মা চিঠির পর চিঠি পাঠাচ্ছেন, আমি যেনো একবার বাড়ি থেকে ঘুরে আসি। অনেকদিন হলো বাড়ী যাওয়া হয়নি। তাই আমার মনটাও কেমন উতলা হয়ে উঠলো বাড়ি যাওয়ার জন্য।
কিন্তু কিছুতেই ছুটি পাচ্ছি না । এখনকার মতো তখন যদি মোবাইল থাকতো তা হলে কতই না ভালো হতো। মুহূর্তের মধ্যেই মায়ের সাথে যোগাযোগ করতে পারতাম।
শেষে একদিন সেনানিবাস থেকে দূরে এক জঙ্গল এলাকায় আমরা ট্রেনিংয়ে গেলাম। সেখান থেকেই দুই দিনের ছুটি পেয়ে গেলাম। তখন সে কী আনন্দ! অনেকদিন পর বাড়ী যাওয়া হবে। সেদিনই বাড়ীর উদ্দেশ্যে রওনা হলাম। রাতেই বড় রাস্তায় গিয়ে আমি বাসে উঠলাম। সবকিছু গোছগাছ করে রওনা দিতে দিতে অনেক রাত হয়ে গেছিল।
তারপর রাত দুটোর দিকে চৌরাস্তায় এসে নামলাম। তখন শীতকাল, চারদিকে কুয়াশায় ঢাকা। পথঘাট জনশূন্য। এতো রাতে মানষ থাকারও কথা নয়।
আমি রাস্তা ধরে বাড়ীর উদ্দেশ্যে হাটতে লাগলাম। তখনকার দিনে আজকের মতো এতো গাড়ী ছিল না। তাই বাড়ি ফেরার একমাত্র অবলম্বন ছিলো হাঁটা।
কিছুক্ষন হাটার পর পাকা রাস্তা শেষ হয়ে গেলো। আমি পাকা রাস্তা ছেড়ে কাঁচা রাস্তায় নেমে পড়লাম। গাছপালাঘেরা অন্ধকার পথ। আবছা আলোয়ই আমি আপন মনে হাঁটছি। রাস্তায় কোনো ল্যাম্পপোস্ট নেই। তখন ছিলো জ্যোৎস্নার রাত। তাই পথ খুঁজে পেতে আমার কোনো অসুবিধা হলো না।
তখন আমার মিলিটারি মেজাজ। ভয় ডর বলে কিছু নেই। অতচ ছোটবেলায় রাত্রিবেলায় এই রাস্তা দিয়ে হাটার সময় কত ভয় পেতাম! গায়ে চাদর, মাথায় মাফলার এবং পায়ে কালো মিলিটারি বুট।
আমি হাঁটতে হাঁটতে দিঘির কাছে চলে এসেছি। দিঘিটা এখন আর আগের মতো নেই। দিঘির চারদিকে ছিলো তালগাছের সারি। লোকে বলতো দিঘির পাড়ের ভূত থাকে। কিন্তু আমার সামনে কোনো দিন পড়েনি বলেই দাদু হা হা করে হাসলেন।
তারপর বললেন, দিঘির পড়েই কিছুটা ইটের তৈরী হাঁটার পথ। তারপর মসজিদ। আগে মসজিদটি টিনের ছিলো। এখন অবশ্য মসজিদটি পাকা করা হয়েছে।
দ্বিতীয় পার্ট পড়ুনঃ শিক্ষনীয় হাসির গল্প দাদুর চোর ধরা পার্ট ২