প্রথম পার্ট পড়ুনঃ বাস্তব জীবনের ছোট গল্প আগন্তুক বৃদ্ধ
এমন গরমেও মাঠে ঘাটে কাজ করছে কিছু লোক। রিকশা চালাচ্ছে কেউ কেউ। কেউ আবার মাটি খোঁড়াখুঁড়ি করছে। এদের কথা ভেবে কষ্ট হয় ওয়াসিমের।
ওরা অপেক্ষা করছে বৃদ্ধটির জন্য। কখন আসবে চেয়ে আছে পথের দিকে। ওদের তিনজনের হাতেই তিনটি কাপড়ের ব্যাগ। বাসার কিছু পুরনো জামা-কাপড় নিয়ে এলো তিনজন। সাথে পাঁচশ করে টাকা। বৃদ্ধের হাতে তুলে দেবে ওরা। নিশ্চয় খুশি হবে বৃদ্ধটি।
এখনো আসেনি বৃদ্ধ। দূরে কোথাও গিয়েছে হয়তো আসতে দেরি হচ্ছে। বললো পিয়াল।
সীমান্ত বললো- আসবে নিশ্চয়। চাচা নিশ্চয় ওয়াদা মিস করবে না।
ওয়াসিম বললো- দেখে মনে হয়েছে। কথার খেলাপ করবে না চাচা। আমাদের জন্য যে আন্তরিকভাবে দোয়া করেছেন। আমার ভাবতেই ভালো লাগছে।
কত মানুষ আসছে যাচ্ছে। বৃদ্ধটি আসছে না। হাতে সময় বেশি নেই। গরমও এত বেপরোয়া। গাছের ছায়ায় হলেও ঘামে ভেজা তিনজন।
বৃদ্ধের পথের দিকে চেয়ে আছে ওরা। না বৃদ্ধের ছায়াও নেই। তবে কি আসবে না? নাকি ভুলেই গেলো ওয়াসিমদের কথা। হতেও পারে। মানুষ বুড়ো হয়ে গেলে হয়তো অনেক কিছু মনে থাকে না। ভাবে ওয়াসিম
সীমান্ত বললো- খামোখাই আমরা জামা কাপড় নিয়ে এলাম। আমাদের ক্লাস শুরু হয়ে যাচ্ছে। চাচার কোনো হদিস নেই।
পিয়াল বললো- ভুলটা আমরাই করেছি। চাচার ঠিকানাটা রেখে দেয়া উচিত ছিলো।
ওয়াসিম বললো- পিয়াল ঠিকই বলেছে। উচিত ছিলো ঠিকানাটা রাখা। ঠিকানা ছাড়া কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না।
তোর মাথায় তখন এই বুদ্ধি এলো না কেন? তুইতো আমাদের থেকে বেশি বুদ্ধি রাখিস। ওয়াসিমকে বললো সীমান্ত।
ওয়াসিম বললো- বুদ্ধি সব সময় কাজ করে নারে। বুদ্ধি এত কাজ করলে বুদ্ধিজীবীই হয়ে যেতাম। বলেই হাসলো সে।
এ সময় রাস্তার দক্ষিণ দিক থেকে ঠিক মাঠের পূর্ব-দক্ষিণ কোনায় দেখা গেলো বেশ কয়েকজন মানুষের জটলা। মানুষের এমন জটলা দেখেই সীমান্তের মনে একটা কৌতূহল জেগে ওঠে। ওয়াসিম ও পিয়ালকে বললো- চল দেখি কি হলো।
পিয়াল যেতে চাইলো না। ততক্ষণে সীমান্ত এগিয়েই চললো। সীমান্তের পথের দিকে তাকিয়ে আছে ওয়াসিম ও পিয়াল।
সীমান্ত পৌঁছে গেলো জটলায়। কয়েক সেকেন্ড মাত্র। জটলা থেকে খানিকটা সরে এলো। খুব অস্থিরতার সাথে হাতের ইশারায় ডাকলো ওয়াসিমদের এবং দ্রুত আসতেই ইঙ্গিত দিলো।
দ্রুত এলো ওয়াসিম পিয়াল। এসেই উকি দিলো। ভিরমি খেয়ে গেলো ওয়াসিম ও পিয়াল। এই প্রচন্ড গরমে সেন্স হারিয়েছে বৃদ্ধটি। হায় হায় করে উঠলো ওয়াসিম। একি হলো চাচা! চিৎকার দিয়ে বললো- পানি পানি। কেউ একটু পানি নিয়ে আসবেন !
মাঠের কোনায় পাতলা দূর্বাঘাসে চিত হয়ে পড়ে আছে বৃদ্ধ মানুষটি। সম্ভবত ওয়াসিমদের দেয়া ওয়াদা রক্ষা করতেই আসছিলেন তিনি। ভর দুপুরে রোদের প্রচন্ড তাপে সেন্স হারিয়েছে। এখন মুখে পানি ছিটাতে হবে।
জটলার বেশির ভাগ মানুষই যেনো সার্কাসের দর্শক। দুই-চারজন কিছুটা দুঃখ প্রকাশ করছে। বাকিরা চেয়ে চেয়ে দেখছে। ওয়াসিমের মুখে পানি শব্দ শুনে একজন মানুষ দৌড়ে গেলো একটি বাসার দিকে।
তারপর একটি ভরা বালতি নিয়ে প্রায় দৌঁড়ানোর চেষ্টা করছে লোকটি। ছলকে ছলকে রাস্তায় পড়ে যাচ্ছিলো পানি। তবুও সম্ভব যতটা দ্রুত গতিতে আসছে। এই গরমেও তিনি থামছেন না। সবাই লোকটিকে সাধুবাদ জানাচ্ছে।
ওয়াসিম লোকটির দিকে কয়েক কদম এগিয়েও গেলো। লোকটির হাত থেকে নিলো বালতিটি। বৃদ্ধের মাথার পাশে বালতি রাখলো। দুই হাতে পানি নিলো। বৃদ্ধের মুখের ওপর পানি ঢালতে যাবে এমন সময় আনতেই শুরু হলো ঝমঝম বৃষ্টি। আকাশে মেঘ জমেছে কখন খেয়ালই করেনি কেউ। আজ আষাঢ়ের ষোলো দিনের মাথায় নামলো বৃষ্টি।
সবার চোখ বৃদ্ধের দিকে। ত্রিশ চল্লিশ সেকেন্ড বৃষ্টি পড়ছে। বৃষ্টির ফোঁটা যেনো আঘাত করছে শরীরে। বৃষ্টি গায়ে লাগতে একটুখানি নড়ে উঠলো বৃদ্ধটি।
চাচা, চাচা- ডাকলো ওয়াসিম। না চাচার কোনো সাড়া নেই। চোখ খোলার চেষ্টা করছেন চাচা ।
ওয়াসিমদের মনে আশা জেগে উঠলো- হয়তো বেঁচে যাবে লোকটি। চোখ খোলার চেষ্টা করছে। বৃষ্টির ফোঁটার তীব্রতার দরুন পারছে না। চোখের উপর হাত রাখলো ওয়াসিম। এখন বৃষ্টির ফোঁটাগুলো ওয়াসিমের হাতের ওপর পড়ছে। ধীরে ধীরে চোখ খুললো বৃদ্ধ। ওয়াসিমকে দেখলো। খুব ক্ষীণ কণ্ঠে বললো- বাবা পানি। একটু পানি খাব।
ওই যুবকটি দৌড় দিলো আবার। খাবার পানি সংগ্রহের জন্য ছুটলো সে। সীমান্তর মাথায় এলো বুদ্ধি। দুই হাত বৃষ্টির মধ্যে ধরলো। অঝোর ধারায় বৃষ্টির পানি জমছে ওর হাতে। বৃষ্টির পানিই মুখে দিলো বৃদ্ধের। একই কাজ করলো পিয়ালও। বৃষ্টির পানি খেয়ে বৃদ্ধের প্রাণ যেনো ফিরে এলো।
হাত পা নাড়াচাড়া করলো বৃদ্ধ। মাথা ধরে বসানোর চেষ্টা করছে ওয়াসিম। জটলার আরো দুই একজন সাহায্য করলো।
ওয়াসিমের সাথে ঠেস দিয়েই বসলো লোকটি। ওয়াসিম বললো- চাচা আমরা আপনার জন্য জামা কাপড় এনেছি। কিছু টাকাও এনেছি। চলুন চাচা আপনাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবো।
ডুকরে কেঁদে উঠলেন চাচা। বললেন- আমার ছেলেটাও এই প্রচন্ড গরম্র মারা গেছিল। আমি মরতে মরতে বেঁচে গেছি। আমার ছেলেটাই চইলা গেলো। হায়রে কপাল! এই কপালে খালি দুঃখের ছবি। বলেই কাঁদছে বৃদ্ধ।
বৃদ্ধের চোখের অশ্রু বৃষ্টির পানিতে মিশে যায়। দুই চোখের পানি গড়িয়ে যায় বৃদ্ধের শরীর বেয়ে। এখনো বৃদ্ধের দুঃখগুলো অশ্রু হয়ে ঝরে যাচ্ছে। আর তা ধুয়ে দিচ্ছে আষাঢ়ের বৃষ্টি।